
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Biography
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে যে কয়েকজন ব্যক্তিত্ব কালজয়ী প্রভাব রেখেছেন, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১) অন্যতম। কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ—একাধারে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি কেবল বাংলা সাহিত্যেই নয়, গোটা বিশ্বে ভারতের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে উজ্জ্বল করেছেন। তাঁর “গীতাঞ্জলি”-র জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ছিল বাংলা ভাষার প্রথম বিশ্বজয়। আজও তাঁর চিন্তা, সৃষ্টি ও আদর্শ আমাদের প্রেরণা জোগায়।
জন্ম ও বাল্যজীবন
১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ব্রাহ্মসমাজের নেতা) এবং মাতা সারদা দেবী। ঠাকুর পরিবার ছিল বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল—যেখানে সাহিত্য, সংগীত ও দর্শনের চর্চা নিত্যদিনের বিষয় ছিল।
সাহিত্য ও শিল্পের জগতে বিপ্লব
রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। কলকাতার বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি হলেও তিনি প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছিলেন গৃহশিক্ষকদের কাছ থেকে এবং বই ও প্রকৃতির মাঝে। ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে গেলেও আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি না নিয়ে ১৮৮০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
কবিতা: গীতাঞ্জলি থেকে বিশ্বজয়
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মিলেছে আধ্যাত্মিকতা, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানবতার গভীরতা।
-
“গীতাঞ্জলি” (১৯১০): এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
-
“সোনার তরী”, “বলাকা”, “মানসী”: প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে নতুন ছন্দ ও ভাবনার সন্ধান।
উপন্যাস: সমাজের আয়না
-
“গোরা” (১৯১০): হিন্দু-ব্রাহ্ম সমাজের দ্বন্দ্ব ও জাতীয়তাবাদের অন্বেষণ।
-
“চোখের বালি” (১৯০৩): নারীমনের জটিলতা ও সমাজের রূঢ় বাস্তবতা।
-
“ঘরে বাইরে” (১৯১৬): স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে প্রেম ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব।
ছোটগল্প: সাধারণ মানুষের অসাধারণ গল্প
-
“কাবুলিওয়ালা”: এক আফগান ফলের বিক্রেতার সঙ্গে এক বাঙালি মেয়ের মর্মস্পর্শী সম্পর্ক।
-
“পোস্টমাস্টার”: গ্রামীণ জীবনের নিঃসঙ্গতা ও মানবিকতা।
নাটক: মঞ্চে জীবনদর্শন
-
“রক্তকরবী”: যান্ত্রিক সভ্যতা বনাম মানবিক মূল্যবোধ।
-
“ডাকঘর”: মৃত্যুকে জয়ের প্রতীকী কাহিনি।
সংগীত: রবীন্দ্রসংগীতের মহীরুহ
রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ২,৩০০-এর বেশি গান, যা “রবীন্দ্রসংগীত” নামে পরিচিত। তাঁর গানে মিলেছে প্রকৃতি, প্রেম, ভক্তি ও দেশাত্মবোধ।
-
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত “জনগণমন”
-
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা”
শিক্ষা ও সমাজসংস্কার
শান্তিনিকেতন: প্রকৃতির কোলে শিক্ষা
১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন, যা পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯২১) রূপ নেয়। এখানে শিক্ষার আদর্শ ছিল “জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয়”—যেখানে প্রকৃতি, সংগীত ও শিল্পের গুরুত্ব সমান।
জাতীয়তাবাদ বনাম বিশ্বমানবতা
রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন-কে সমর্থন করলেও অন্ধ জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের (১৯১৯) প্রতিবাদে “নাইটহুড” উপাধি ত্যাগ করেন।
শেষজীবন ও উত্তরাধিকার
ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি
জীবনের শেষদিকে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও দুই কন্যার মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করে।
মৃত্যু ও অমরতা
৭ আগস্ট, ১৯৪১ (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি আজও বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক।
“রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, তিনি একটি যুগের নাম।” — সুকান্ত ভট্টাচার্য
গান
- আগে চল, আগে চল
- আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে
- আপনি অবশ হলি
- আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে
- আমরা সবাই রাজা
- আমাদের যাত্রা হল শুরু
- আমার সোনার বাংলা
- আমি ভয় করব না
- এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে
- ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা
- জনগণমন-অধিনায়ক
- তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে
- দেশ দেশ নন্দিত করি
- নাই নাই ভয়
- নিশিদিন ভরসা রাখিস
- বাংলার মাটি বাংলার জল
- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
- সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান
- হে মোর চিত্ত