
কাজী নজরুল ইসলাম
Biography
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও দর্শন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও নজরুলের প্রতিভা শৈশব থেকেই প্রকাশ পায়।
শিক্ষা ও যৌবন
নজরুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র দশ বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর জীবিকার তাগিদে তিনি মক্তবে শিক্ষকতা, মসজিদের খাদিম এবং লেটো দলের গায়ক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি রুটির দোকানেও কাজ করেছেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীন সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।
সাহিত্যিক জীবন
নজরুলের সাহিত্যিক জীবন বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল। তাঁর প্রথম কবিতা “মুক্তি” প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। এরপর তিনি “বিদ্রোহী” (১৯২২) কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেন। এই কবিতায় তিনি অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন, যা তাঁকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।
নজরুলের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- অগ্নিবীণা (১৯২২)
- সঞ্চিতা (১৯২৫)
- ফণিমনসা (১৯২৭)
- চক্রবাক (১৯২৯)
তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন, যা “নজরুল সঙ্গীত” নামে পরিচিত। তাঁর গানে মানবতা, প্রেম, দ্রোহ ও স্বাধীনতার বার্তা ফুটে উঠেছে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা
নজরুল শুধু কবি নন, তিনি ছিলেন সামাজিক ন্যায় ও স্বাধীনতার পক্ষের এক অকুতোভয় যোদ্ধা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন এবং “ধূমকেতু” পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে স্বাধীনচেতা ভাবনা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর লেখনীতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বার্তা রয়েছে। তিনি মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯২৪ সালে নজরুল প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁদের তিন পুত্রসন্তান: কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (কাজী সব্যসাচী) এবং কাজী অনিরুদ্ধ। দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৪২ সালে নজরুল এক ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে ধীরে ধীরে বাকশক্তি ও স্মৃতিশক্তি হারাতে বাধ্য করে।
মৃত্যু ও স্বীকৃতি
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) নজরুল ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “জাতীয় কবি” হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে “নজরুল ইনস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠা করা হয়। নজরুলের কবিতা, গান ও দর্শন আজও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন, তিনি বাংলার মুক্তিসংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রতীক। তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীত সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে মানুষের মনে আশা ও সংগ্রামের প্রেরণা জোগায়। নজরুলের জীবন ও কর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়—নিজের বিশ্বাসে অটল থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখার।
“চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল—
নিম্নে উতলা ধরণী, তরঙ্গ উঠে আকাশে!”
— নজরুলের এই অমর পঙ্ক্তি আজও আমাদের সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত করে।
কবিতা
- অ-নামিকা
- আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
- আমার কৈফিয়ৎ
- আমি হব সকাল বেলার পাখি (খোকার সাধ)
- কাণ্ডারী হুঁশিয়ার
- খুকী ও কাঠবিড়ালি
- নারী
- বিদ্রোহী
- মানুষ
- লিচু চোর
- সংকল্প
- সাম্যবাদী
গান
- অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে
- অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী
- আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়
- আমায় নহে গো
- আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
- আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী
- আমার গানের মালা
- আমার সাম্পান যাত্রী
- আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে
- আমি চিরতরে দূরে চলে যাব
- আলগা কর গো খোঁপার বাধন
- আসে বসন্ত ফুলবনে
- এই রাঙামাটির পথে লো
- এত জল ও – কাজল চোখে
- ওগো প্রিয়, তব গান
- করুণ কেন অরুণ আঁখি
- কে বিদেশী মন – উদাসী
- কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
- কেন আনো ফুলোডোর
- কেন কাঁদে পরান কী বেদনায় কারে কহি
- খেলিছ এ বিশ্বলয়ে
- খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে
- গঙ্গা সিন্ধু নর্ম্মদা কাবেরী যমুনা ওই
- গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে যায়
- চেয়ো না সুনয়না
- চোখ গেল চোখ গেল
- তুমি আমার সকাল বেলার সুর
- তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
- তৌহীদের মুর্শিদ আমার
- ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ